Saturday, April 11, 2015

ইউসুফ কারজাবির রাষ্ট্রচিন্তা

Source LINK 

ইউসুফ কারজাবির রাষ্ট্রচিন্তা// শাহ্ আব্দুল হান্নান

ড. ইউসুফ আল কারজাবির জন্ম ১৯২৬ সালে। ১৯৭৩ সালে তিনি আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নেন। তিনি আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন অব ইসলামিক স্কলারসের সভাপতি। এ পর্যন্ত তার ৪২টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টির মতো বাংলায় পাওয়া যায়।

এ নিবন্ধে আমি তার ‘ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা, তত্ত্ব ও প্রয়োগ’ বইটি নিয়ে আলোচনা করব। বইটির মূল আরবি নাম ‘মিন ফিকহি আদ দাওলাহ ফিল ইসলাম’। বইটি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইসলামিক থট (বিআইআইটি) প্রকাশ করেছে। তাদের ঠিকানাÑ রোড নম্বর-২, হাউজ নম্বর-৪, সেক্টর-৯, উত্তরা।
তিনি প্রথম অধ্যায়ে ইসলামি রাষ্ট্রের গুরুত্ব আলোচনা করেছেন। তিনি প্রথমেই বলেন, ‘পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ এ কথা মুসলিমদের মনে ঢুকিয়ে দিতে সুযোগ হয়েছে, যার সারসংক্ষেপ হচ্ছে ইসলাম কিছু বিধিবিধান সংবলিত ধর্মমাত্র। রাষ্ট্র পরিচালনা এবং রাষ্ট্রীয় বিধানের সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে বিদ্যাবুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষ রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মনীতি প্রণয়ন করবে। এখানে ধর্মের কোনো স্থান নেই (পৃ-১)।
তিনি আরো বলেন, ‘তাদের ভ্রান্ত স্লোগান হচ্ছে, ধর্ম আল্লাহর এবং রাষ্ট্র সবার।’ এর ভুল ব্যাখ্যা গ্রহণ করা হয়। এ স্লোগানকে সম্পূর্ণ উল্টিয়ে আমরা বলতে পারি, ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয়ই আল্লাহর জন্য’ অথবা এও বলতে পারি, ‘ধর্ম সবার জন্য এবং রাষ্ট্র আল্লাহর জন্য।’
ড. কারজাবি প্রথম অধ্যায়ে কুরআন, ইসলামের ইতিহাস ও ইসলামের প্রকৃতি থেকে ইসলামি রাষ্ট্রের পক্ষে দলিল-প্রমাণাদি পেশ করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সূরা নিসার আয়াত পেশ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ, রাসূল ও তোমাদের দায়িত্বশীলদের আনুগত্য করো’ (নিসা : ৫৮-৫৯)।
ইতিহাস থেকে তিনি বলেন, রাসূল সা: প্রথম থেকেই একটি নির্ভেজাল ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট ছিলেন এবং প্রথম সুযোগেই তিনি মদিনায় ইসলামি রাষ্ট্র স্থাপন করেন (পৃ:-৬)। রাসূল সা:-এর ওফাতের পর মুসলিমরা প্রথমে যে কাজটি করেন, তা হচ্ছে তাদের রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচন করা। এটি রাষ্ট্রের গুরুত্ব প্রমাণ করে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিনি দেখাচ্ছেন যে, ইসলামি রাষ্ট্র কোনো থিওক্র্যাসি তথা নেতা বা আলেম শাসিত রাষ্ট্র নয়। এটি একটি নাগরিক ও দেওয়ানি রাষ্ট্র। এটি একটি সাংবিধানিক ও আইনগত রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র রাজতন্ত্র নয়, পরামর্শভিত্তিক রাষ্ট্র। তিনি বলেন, ইসলামি রাষ্ট্র গণতন্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ইসলামি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অনুলিপি। ইসলামি রাষ্ট্র একটি হেদায়াত ও কল্যাণকর রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্র অসহায় ও দুর্বলদের আশ্রয়স্থল। এটি স্বাধীনতা ও অধিকার আদায়ের রাষ্ট্র এবং এটি একটি চারিত্রিক ও আদর্শিক রাষ্ট্র (পৃ: ২৬-৫৮)।
তৃতীয় অধ্যায়ে তিনি ইসলামি রাষ্ট্রের প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে, এটি একটি বেসামরিক ও নাগরিক রাষ্ট্র। এটি থিওক্র্যাসি নয়। সেকুলারপন্থীদের দাবিÑ ইসলাম একটি ধর্মীয় পুরোহিত শাসিত রাষ্ট্রের কথা বলেছে। এ সন্দেহ তিনি শক্তভাবে দূর করেন। এমনকি তিনি ইরানকে যারা পুরোহিততন্ত্র বলতে চান, তার বিরুদ্ধেও তিনি বলেন, ইরান মূলত একটি নির্বাচিত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র (পৃ: ৬৪-৮৪)
চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি কিছু ভুল চিন্তার সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। অনেকে মনে করেন, ইসলামি রাষ্ট্রের প্রধানের জন্য মেয়াদ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তিনি দলিল দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তা করা যায়। তিনি অনেক প্রমাণ দেন যে, খলিফারা একে অপরের সিদ্ধান্ত যুগের প্রেক্ষিতের আলোকে পরিবর্তন করেছেন। তিনি আরো বলেন, এটি বিদআত নয়। সত্যিকারের বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলামে বর্ণিত বিদআতের পরিধি শুধু আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত ও তৎসংশ্লিষ্ট বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু জীবনপথে চলতে গিয়ে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিবর্তিত বিভিন্ন বিধান, আচার-অনুষ্ঠান, কৃষ্টি-কালচার এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকসহ নানাবিধ বিষয়ে বিদআতের কোনো অংশ নেই’ (পৃ:-৯৭-১০০)।
তিনি আরো একটি বিষয় পরিষ্কার করেছেন, আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান মোতাবেক আমল করা অত্যাবশ্যক। এ ব্যাপারে তিনি সূরা আজহারের ৩৬ আয়াত (৩৩:৩৬) ও মায়েদার ৪৪-৪৭ (৫:৪৪-৪৭) উল্লেখ করেছেন। মায়েদার আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর নাজিল করা আইন মোতাবেক শাসন করে না, তারা কাফের, জালেম ও ফাসেক।’ ইসলামের প্রায় সব আলেম এমত দিয়েছেন যে, যদিও আয়াতগুলো বনি ইসরাইলকে লক্ষ্য করে নাজেল করা হয়েছিল, তথাপি বিষয়বস্তু সর্বজনীন হওয়ায় তা মুসলিমদের ওপরও প্রযোজ্য। তবে ড. কারজাবি বলেছেন, এখানে কাফের অর্থ অবিশ্বাসী হবে না, যদি তারা বাধ্য হয়ে ইসলামি আইন প্রয়োগ করতে না পারেন। তিনি শাসকদের দুই ভাগ করার কথা বলেছেন। এক দল, যারা ইসলামকে ইচ্ছাকৃতভাবে উপেক্ষা করে এবং আরেক দল, যারা বাধ্য হয়ে ইসলামি আইন চালু করতে পারে না।
পঞ্চম অধ্যায়ে তিনি অনেক বিষয় এনেছেন। প্রথমত, গণতন্ত্রকে তিনি ইসলামের সাথে সঙ্গতিশীল মনে করেন। তিনি উল্লেখ করেন, গণতন্ত্রের মূল কথা ইসলামের সাথে নীতিগতভাবে এক। অবশ্য ইসলামি গণতন্ত্রে মূল আইন ইসলাম হবে। গণতন্ত্রের শাসন সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে হয়। ইসলামের ইতিহাসে অনেক দৃষ্টান্ত আছে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়ার (পৃ: ১৮৮-১৯১)। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন, এ যুগে এবং পূর্বে মুসলিম উম্মাহর দুর্দশার কারণ ছিল অগণতান্ত্রিক এবং স্বেচ্ছাচারী শাসন। তিনি এটাও উল্লেখ করেন, শূরা করা বা পরামর্শ গ্রহণ শুধু দিকনির্দেশক নয়। তা মেনে চলা বাধ্যতামূলক (পৃ: ১৯৪-১৯৫)। তিনি উল্লেখ করেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র ইসলামসম্মত। তিনি বলেন, রাজনীতিতে একাধিক দল ফিকাহর একাধিক মাজহাবতুল্য (পৃ: ২০২-২০৪)।
তিনি মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করেছেন এবং বিরুদ্ধবাদীদের সব যুক্তি খণ্ডন করে বলেছেন, যা তারা আধুনিক গণতন্ত্রের সব পদেই দায়িত্ব পালন করতে পারবেন (পৃ: ২১৭-২৪১)। তিনি অমুসলিমদের পক্ষেও একই ধরনের মতামত দিয়েছেন (পৃ: ২৬৯-২৭৮)।
এ বইটি সবাইকে পড়ে দেখতে অনুরোধ করছি।
লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার

No comments:

Post a Comment